মুফতি মুহাম্মদ মর্তুজা : কোনো জাতির টিকে থাকার জন্য যেমন তাদের জ্ঞান-বিজ্ঞানের উৎকর্ষ, অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি গুরুত্বপূর্ণ; তেমনি তাদের এই উন্নতিগুলো ধরে রাখতে তাদের জাতীয় শক্তি ও প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা শক্তিশালী করাও অপরিহার্য।

জাতীয় স্বাধীনতা টিকে থাকে জাতীয় শক্তির কারণে। শক্তিহীন কোনো জাতি তার স্বাধীনতা টিকিয়ে রাখতে পারে না। তাই প্রতিটি রাষ্ট্র কিংবা জাতির উচিত তাদের প্রতিরক্ষাব্যবস্থা ও জাতীয় শক্তি বৃদ্ধির প্রতিও গুরুত্ব দেওয়া।

শুধু অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের উন্নতিতে থেমে না থাকা।
পবিত্র কোরআনে মহান আল্লাহ মুসলিম জাতিকে উদ্দেশ করে ইরশাদ করেন, ‘আর তাদের মোকাবেলার জন্য তোমাদের সামর্থ্য অনুযায়ী শক্তি ও অশ্ব বাহিনী প্রস্তুত করো, তা দ্বারা তোমরা ভয় দেখাবে আল্লাহর শত্রু ও তোমাদের শত্রুদের। এবং এরা ছাড়া অন্যদেরও, যাদের তোমরা জানো না—আল্লাহ তাদের জানেন। আর তোমরা যা আল্লাহর রাস্তায় খরচ করো, তা তোমাদের পরিপূর্ণ দেওয়া হবে, তোমাদের ওপর জুলুম করা হবে না। ’ (সুরা : আনফাল, আয়াত : ৬০)

এই আয়াতে মহান আল্লাহ তাঁর বান্দাদের প্রতিরক্ষাব্যবস্থা জোরদার করার নির্দেশ দিয়েছেন। সমর যুদ্ধোপকরণ, অস্ত্রশস্ত্র, যানবাহন প্রভৃতি এবং শরীরচর্চা ও সমর বিদ্যা শিক্ষা করাও অন্তর্ভুক্ত। এখানে শুধু তৎকালে প্রচলিত অস্ত্রশস্ত্রের কোনো উল্লেখ করা হয়নি, বরং ব্যাপক অর্থবোধক শব্দ ‘শক্তি’ ব্যবহার করে ইঙ্গিত দিয়েছে, ‘শক্তি’ প্রতিটি যুগ, দেশ ও স্থান অনুযায়ী বিভিন্ন রকম হতে পারে। তৎকালীন অস্ত্র ছিল তীর, তলোয়ার, বর্শা প্রভৃতি। এরপর বন্দুক-তোপের যুগ এসেছে। তারপর এখন চলছে উন্নত প্রযুক্তির কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন রোবট যোদ্ধা ও পারমাণবিক অস্ত্রের যুগ। ‘শক্তি’ শব্দটি এ সব কিছুতেই ব্যাপক। সুতরাং যেকোনো বিদ্যা ও কৌশল শিক্ষা করার প্রয়োজন হবে সেসব যদি এই নিয়তে হয় যে তার মাধ্যমে ইসলাম ও মুসলিমদের শত্রুকে প্রতিহত করা এবং অবিশ্বাসীদের মোকাবেলা করা হবে, তাহলে মহান আল্লাহর কাছে এর উত্তম প্রতিদান পাওয়া যাবে।

প্রতিরক্ষাব্যবস্থাকে অবহেলা করা নিজেদের ধ্বংসের দিকে ডেকে নেওয়ার নামান্তর। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘আর তোমরা আল্লাহর রাস্তায় ব্যয় করো এবং নিজ হাতে নিজেদের ধ্বংসে নিক্ষেপ কোরো না। আর সুকর্ম করো। নিশ্চয়ই আল্লাহ সুকর্মশীলদের ভালোবাসেন। ’ (সুরা : বাকারা, আয়াত : ১৯৫)

এ আয়াতে স্বেচ্ছায় নিজেদের ধ্বংসের মুখে নিক্ষেপ করতে নিষেধ করা হয়েছে। এখন প্রশ্ন হলো, ‘ধ্বংসের মুখে নিক্ষেপ করা’ বলতে এ ক্ষেত্রে কী বোঝানো হয়েছে? এ প্রসঙ্গে তাফসিরবিদদের অভিমত বিভিন্ন প্রকার। ১. আবু আইয়ুব আনসারি (রা.) বলেন, এই আয়াত আমাদের সম্পর্কেই অবতীর্ণ হয়েছে। আমরা এর ব্যাখ্যা উত্তমরূপেই জানি। কথা হলো এই যে আল্লাহ তাআলা ইসলামকে যখন বিজয়ী ও সুপ্রতিষ্ঠিত করলেন, তখন আমাদের মধ্যে আলোচনা হলো যে এখন আর যুদ্ধ বা প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার কী প্রয়োজন? এখন আমরা আপন গৃহে অবস্থান করে বিষয়-সম্পত্তির দেখাশোনা করি। এ প্রসঙ্গেই এ আয়াতটি অবতীর্ণ হয়। (আবু দাউদ, হাদিস : ২৫১২)

এতে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে যে ‘ধ্বংসের দ্বারা এখানে যুদ্ধ পরিত্যাগ করা বোঝানো হয়েছে। ’ কারণ কোনো জাতি যখন প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার দিক থেকে দুর্বল হয়ে পড়ে, তখন তাদের স্বাধীনতা ধরে রাখা অনিশ্চিত হয়ে ওঠে। মুহূর্তেই তাদের অনৈতিক সমৃদ্ধি ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের উৎকর্ষ অর্থহীন হয়ে উঠতে পারে।

প্রতিরক্ষাব্যবস্থা বা জাতীয় শক্তির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নির্ধারক/উপাদান হচ্ছে সামরিক প্রস্তুতি। সামরিক শক্তির ওপর নির্ভর করেই আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে শক্তির পরিমাপ করা হয়। সামরিক ক্ষমতার ভিত্তিতেই ‘পরাশক্তি’ কিংবা ‘প্রধান শক্তির’ প্রতিষ্ঠা ঘটেছে। কোনো দেশের সামরিক প্রস্তুতি কতটুকু, তা নির্ভর করে প্রতিরক্ষা বাহিনীর সংখ্যাগত ও গুণগত বিবেচনার ওপর। স্থল, জল ও আকাশ সীমার নিরাপত্তা এবং এসব ক্ষেত্রে প্রতিপক্ষকে প্রতিহত করার জন্য তাদের চেয়ে বেশিসংখ্যক সদস্যের বাহিনী থাকা দরকার। শুধু বেশি সংখ্যার সশস্ত্র বাহিনীই নয়, তাদের হাতে অত্যাধুনিক অস্ত্র ও সরঞ্জামও থাকতে হবে। এ ছাড়া সামরিক নৈপুণ্য, সুযোগ্য সামরিক নেতৃত্ব এবং উচ্চ মনোবলের অধিকারী সুশৃঙ্খল সামরিক বাহিনী জাতীয় শক্তি অর্জনের জন্য অপরিহার্য। তবে বর্তমান যুগে গতানুগতিক পদাতিক, নৌ ও বিমান বাহিনীর শক্তির ওপর সামরিক প্রস্তুতি সর্বাংশে নির্ভরশীল নয়। আণবিক অস্ত্র এবং আন্তর্মহাদেশীয় ক্ষেপণাস্ত্রসহ কৌশলগত অস্ত্রভাণ্ডারের ওপর জাতীয় শক্তি বহুলাংশে নির্ভরশীল। তাই যেসব দেশ এ ধরনের অস্ত্র উৎপাদন ও তা ব্যবহার করায় যত বেশি সামর্থ্য অর্জন করতে পারবে, সেসব দেশ হয়ে উঠবে তত বেশি শক্তিশালী।

তার মানে নিজেদের প্রতিরক্ষাব্যবস্থা জোরদারের একটি অন্যতম অংশ হলো ক্ষেপণশক্তির সক্ষমতা অর্জন করা। এ ব্যাপারে মুসলিম শরিফের ‘কিতাবুল ইমারাত’ বা প্রশংসা ও নেতৃত্ব অধ্যায়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ হাদিস আছে। উকবা ইবন আমির (রা.) বলেন, রাসুল (সা.)-কে মিম্বারের ওপর আসীন অবস্থায় আমি বলতে শুনেছি, আল্লাহ তাআলার বাণী—‘এবং তোমরা তাদের মোকাবেলায় শক্তি সঞ্চয় করে রাখো। ’ জেনে রাখো, এ শক্তি হচ্ছে ক্ষেপণশক্তি, জেনে রাখো শক্তি হচ্ছে ক্ষেপণশক্তি, জেনে রাখো শক্তি হচ্ছে ক্ষেপণশক্তি। (মুসলিম, হাদিস : ৪৮৪০)

উল্লিখিত হাদিসে মহানবী (সা.) ক্ষেপণশক্তি অর্জনের প্রতি বিশেষভাবে গুরুত্ব দিয়েছেন। মহানবী (সা.)-এর যুগে ক্ষেপণশক্তি বলতে বোঝানো হতো তীর, বর্শা ইত্যাদিকে; যেগুলো দিয়ে দূর থেকে শত্রুকে পরাস্ত করা যেত। কিন্তু এর পরে এই প্রযুক্তিতে আরো অনেক উন্নতি সাধিত হয়েছে। যে জাতি এই হাদিসের ওপর আমল করতে চায়, তাদের সে যুগের ক্ষেপণশক্তির সর্বোচ্চ উন্নত মাধ্যমটির শক্তি অর্জনই হলো হাদিসের উদ্দেশ্য। এ কারণে প্রতিটি মুসলিম রাষ্ট্রনায়কের উচিত, তাঁদের দেশ, জাতি ও ধর্মের নিরাপত্তায় প্রতিরক্ষাব্যবস্থার প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া। নিয়ত পরিশুদ্ধ থাকলে এতে রাষ্ট্রের নিরাপত্তা যেমন অর্জন হবে, তেমনি আল্লাহর আদেশ পালনের সওয়াবও পাওয়া যাবে।